SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - পূজা-পার্বণ, মন্দির ও তীর্থক্ষেত্র | NCTB BOOK

আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে জেনেছি, পূজা শব্দের অর্থ প্রশংসা করা বা শ্রদ্ধা করা। নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দেব-দেবীকে আমরা বিভিন্নভাবে আরাধনা করি। ফুল-ফল ও নানা উপচার দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। এই শ্রদ্ধা নিবেদন করার প্রক্রিয়াই হলো পূজা। পূজার মাধ্যমে সকল অশুভ শক্তি দূর হয়। জীবের কল্যাণ সাধিত হয়। আবহমান কাল থেকে আমাদের প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনে মঙ্গল কামনায় যে সমস্ত আনন্দ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা করা হয় তা-ই পার্বণ। এখন আমরা কয়েকজন দেব-দেবী সম্পর্কে জানব।

লক্ষ্মীদেবীর পরিচয়

লক্ষ্মীদেবী ধনসম্পদ, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তাঁর অপর নাম শ্রী। তিনি সত্ত্বগুণময়ী। দেবী লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুর সহধর্মিণী। তিনি স্নিগ্ধতা ও সুন্দরের প্রতীক। আমাদের পরিবার ও সমাজের উন্নতি নির্ভর করে সম্পদের ওপর। এই সম্পদগুলোর মধ্যে ভূমি, শস্য, জ্ঞান, সততা, শুদ্ধতা ইত্যাদি অন্যতম। এসব সম্পদ অর্জনের জন্য লক্ষ্মীদেবীর পূজা করা হয়।

লক্ষ্মীদেবী পদ্মফুলের ওপর উপবিষ্ট। তিনি গৌরবর্ণা। তাঁর দুটি হাত। এক হাতে তিনি ধরে থাকেন পদ্ম আরেক হাতে অমৃতের কলস। তাঁর বাহন পেঁচা। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা করা হয়। এ পূজা কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা নামে পরিচিত। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার বাংলার ঘরে ঘরে পাঁচালী পড়েও লক্ষ্মীপূজা করা হয়।

পূজা পদ্ধতি

যে কোনো পূজা করতে পূজা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। পূজার ক্ষেত্রে শুদ্ধ আসনে বসে আচমন থেকে শুরু করে পঞ্চদেবতার পূজা করতে হয়। এ পূজায় বিভিন্ন ধরনের আল্পনা বা চিত্র আঁকা হয়।

বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে লক্ষ্মীদেবীর পূজা করা হয়। লক্ষ্মীপূজা পঞ্চোপচার, দশোপচার বা ষোড়শ উপচারে করা হয়ে থাকে। পূজায় ধানের ছড়া, পঞ্চশস্য, সোনা, রূপা, কাঁচা হলুদ, মধু, দধি ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করা হয়। নলটুলীফুল ও পদ্মফুল লক্ষ্মীদেবীর প্রিয় ফুল। এ পূজার মৌলিক নীতি হিসেবে দেবী লক্ষ্মীর ধ্যান, পুষ্পাঞ্জলিমন্ত্র, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রণামমন্ত্র পাঠ প্রভৃতি করতে হয়। অবশেষে লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালি পাঠ করে এয়োগণ একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন।

 

লক্ষ্মীদেবীর পুষ্পাঞ্জলিমন্ত্র

ওঁ নমস্তে সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে। 

যা গতিস্তৎ প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্ত্বদর্চনাৎ ।

শব্দার্থ : ওঁ নমস্তে - নমস্কার বা প্রণাম; সর্বভূতানাং - সকল প্রাণীর; বরদাসি - আশীর্বাদ বা মঙ্গল; হরিপ্রিয়ে - - হে হরিপ্রিয়া; যা - যে, গতিঃ - গতি, তৎ - তার; প্রপন্নানাং - আশ্রিত বা শরণাগত; সা - তার; মে - আমার; ভূয়াত্ত্বদৰ্চনাৎ ( ভূয়াৎ তু অদচনাৎ) - প্রচুর বা অধিক অৰ্চনা ।

সরলার্থ : হে হরিপ্রিয়া, তুমি সকল প্রাণীর মঙ্গল করে থাক। তোমার আশ্রিতদের যে গতি হয়, তোমার অধিক অর্চনার দ্বারা আমারও যেন সেই গতি হয়। তোমাকে নমস্কার।

 

লক্ষ্মীদেবীর প্রণামমন্ত্ৰ

ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে। 

সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমোহস্তু তে।

শব্দার্থ : বিশ্বরূপস্য - বিশ্বরূপের; ভার্যাসি - বিষ্ণুর স্ত্রী; পদ্মে - পদ্মা; পদ্মালয়ে - পদ্মের আলয়; শুভে - শুভফল; - সবদিক থেকে; পাহি - রক্ষা করো; মাং - আমাকে; মহালক্ষ্মী - মহালক্ষ্মী; নমোহস্তুতে –তোমাকে - সবতঃ – নমস্কার।

সরলার্থ :  হে দেবী মহালক্ষ্মী, বিশ্বরূপ শ্রীবিষ্ণুর সহধর্মিণী, তুমি পদ্মা, পদ্মের আলয়ে বাস করো। তুমি সকলকে শুভফল দাও। আমাকেও সকল ক্ষেত্রে রক্ষা করো। তোমাকে প্রণাম করি।

লক্ষ্মীপূজার গুরুত্ব:

লক্ষ্মীপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় প্রতি হিন্দু বাঙালি গৃহেই সাড়ম্বরে লক্ষ্মীদেবীর পূজা হয়। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার এবং বিশেষ বিশেষ পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী। তিনি পূজারীকে ধনসম্পদ দান করে থাকেন। লক্ষ্মীদেবীর পূজা করলে সংসারের শ্রী বৃদ্ধি হয়। পূজারীর মন শান্ত হয়। সেই সাথে সংসারে শান্তি স্থাপিত হয়। লক্ষ্মীপূজায় বিভিন্ন নকশার চিত্র এবং আল্পনা আঁকা হয়। এই আল্পনার মধ্যে ধানের ছড়া, লক্ষ্মীদেবীর পায়ের ছাপ, বিভিন্ন মুদ্রার ছাপ, পেঁচার পায়ের ছাপ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে সাধারণ গৃহবধূদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এই পূজার মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ একে অপরের অনেক কাছে চলে আসে। তাদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়। এতে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পায়। ।

নারায়ণদেবের পরিচয়

ভগবান বিষ্ণুর অপর নাম নারায়ণ। তাকে বাস্তুদেবতাও বলা হয়। তিনি পাপ মোচন ও বিঘ্ন নাশকারী দেবতা। ‘নার’ বা ‘নারা” শব্দের অর্থ মানুষ এবং ‘অয়ন' শব্দের অর্থ আশ্রয়। সুতরাং নারায়ণ শব্দের অর্থ সব মানুষ বা সব জীবের আশ্রয়স্থল। তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম ও পরমেশ্বর নামেও পরিচিত। নারায়ণদেবের গায়ের রং উজ্জ্বল নীল। তাঁর চারটি হাতে যথাক্রমে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম শোভা পায়। দুষ্টের বিনাশের জন্য তিনি যেমন গদা ও চক্র ধারণ করেন। ঠিক তেমনি সৎ ও সাধুদের রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর হৃদয় হয়ে ওঠে পদ্মের মতো কোমল। তিনি এ জগতের সব প্রাণীর পালন করে থাকেন, এ কারণে তাঁকে সকল প্রাণীর পালনকর্তা বলা হয়। তাঁর বাহন গরুড় পাখি ।


পূজা পদ্ধতি

প্রতিমারূপে, শালগ্রাম শিলারূপে, তাম্রপাত্রে বা জলে নারায়ণ পূজা করা হয়। পঞ্চশস্য, পঞ্চধাতু এবং বিভিন্ন উপচারে নারায়ণ পূজা করা হয়। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গৃহ প্রবেশ বা যে কোনো শুভ সূচনাতে নারায়ণ পূজা করে থাকে। বিশেষভাবে নির্ধারিত মন্ত্রে নারায়ণ পূজা করা হয়। পূজা শেষে ব্রতকথা শ্রবণ করে আরতি করা হয়। সাদা ও হলুদ ফুল এবং তুলসীপাতা নারায়ণের খুব প্রিয়। যে কোনো মাসের সংক্রান্তিতে, শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে অথবা বৈশাখ মাসে নারায়ণ পূজার প্রচলন বেশি লক্ষ করা যায়।

নারায়ণ দেব

 

নারায়ণদেবের পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্ৰ

ওঁ নমস্তে বিশ্বরূপায় শঙ্খচক্রধরায় চ।
পদ্মনাভায় দেবায় হৃষীকপতয়ে নমঃ।।

শব্দার্থ : ওঁ নমস্তে-তোমাকে নমস্কার; বিশ্বরূপায় - বিশ্বরূপকে; শঙ্খচক্রধরায় - শঙ্খচক্রধারীকে; চ - এবং; পদ্মনাভায় - পদ্ম নাভিতে যাঁর; দেবায় - দেবকে; হৃষীকপতয়ে - ইন্দ্রিয়াধিপতি; নমঃ - নমস্কার। 

সরলার্থ : বিশ্বরূপকে অর্থাৎ বিষ্ণুদেবতাকে প্রণাম। শঙ্খচক্রধারীকে, পদ্মনাভকে, ইন্দ্রিয়াধিপতি নারায়ণদেবকে প্ৰণাম।

নারায়ণ পূজার গুরুত্ব :

নারায়ণদেব এ জগতের সকল প্রাণীর পালনকর্তা। নারায়ণদেবের কাছ থেকে আমরা সন্তানাদিসহ পৃথিবীর সকল প্রাণীকে দায়িত্বের সঙ্গে পালন করার শিক্ষা পাই। তিনি সকল প্রাণীর মধ্যে আত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই আমরা ঈশ্বরজ্ঞানে মানুষসহ সকল প্রাণীকুলকে সেবা করে থাকি। নারায়ণদেবের পূজা করলে পূজারীর মধ্যে নম্রতাবোধ জাগ্রত হয়। নারায়ণদেবের আশীর্বাদে ভক্তের গৃহে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করে। পাপ মোচন হয় এবং সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই ভক্তরা গৃহের সকল বাধা দূর করার জন্য ভক্তিভরে নারায়ণপূজা করেন এবং তাঁর মহিমা কীর্তন করেন।

Content added || updated By

Promotion